আজ আট দিন ধরে বাবা নেই। আমি বিশ্বাসই করতে পারি না, আমার সংস্কৃতিমনা, অসাম্প্রদায়িক বাবাকে আঘাত করে করে মারা হয়েছে। আমার বাবা এমন একজন মানুষ, যিনি ধর্ম নিয়ে কোনো ভেদাভেদ করেননি। মুসলিম বন্ধুর জানাজায় সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে অংশ নিয়েছিলেন। আমরা নিরাপদ নই। অনুগ্রহ করে সবাই মিলে আমার বাবা হত্যার বিচার এনে দিন। আমি আর কিছু চাই না।’বাবার জন্য নাট্যকর্মী অধরা প্রিয়ার কান্না স্পর্শ করে যাচ্ছিল প্রতিবাদে অংশ নেওয়া নির্মাতা, অভিনয়শিল্পী, নৃত্যশিল্পী, সংগীতশিল্পীসহ সংস্কৃতিকর্মীদের। আজ শনিবার বেলা ১১টায় রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে শিল্পীদের প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নেন সাম্প্রদায়িক হামলায় বাবা হারানো অধরা প্রিয়া।





‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার প্রতিবাদে শিল্পী কলাকুশলী সম্প্রীতি সমাবেশ’ শিরোনামে সমাবেশের আয়োজন করে ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গানাইজেশন (এফটিপিও)। প্রতিবাদে অংশ নিয়ে শিল্পীরা সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের মিলেমিশে বসবাসের বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যাশার কথা জানান। সবাইকে সম্মিলিতভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তাঁরা। শিগগিরই সব স্তরের মানুষকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে বড় সমাবেশ কর্মসূচি নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে আয়োজক সংগঠন। শিল্পীরা সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী প্রতিবাদ সমাবেশকে ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নিয়ে যাওয়ার ওপর জোর দেন।





এবার শারদীয় দুর্গোৎসবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, বাড়িঘরে হামলা চালানো ও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ধারাবাহিক ঘটনার মধ্যে ১৩ অক্টোবর হামলার শিকার হন কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগে মাস্টার্সের ছাত্রী এবং ‘দৃষ্টিপাত’ নাট্যদলের সদস্য অধরা প্রিয়ার বাবা দিলীপ দাস। কুমিল্লার রাজেশ্বরী কালীবাড়ি মন্দিরে অঞ্জলি দিতে গিয়েছিলেন তিনি। ওই সময় মন্দিরে অতর্কিতে হামলা চালায় কিছু লোক। হামলাকারীদের ইটের আঘাতে অচেতন দিলীপ দাস ২১ অক্টোবর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনয়শিল্পী তারিক আনাম খান বলেন, ‘অধরা প্রিয়ার সামনে মাথা নত হয়ে যায়। আজ যে বাংলাদেশ দেখছি, সেই বাংলাদেশ আমরা চাইনি। এখনো সময় আছে, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।’





আরেক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পী গাজী রাকায়েত বলেন, ‘এই বাবাকে (অধরার) রক্ষা করতে না পারার দায় আমাদের সবার। এই শক্তি নিয়ে তুমি (অধরা) এগিয়ে যাও। তোমার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশে পরিণত হবে।’ তিনি আরও বলেন, সংস্কৃতিবিহীন মানুষ শুধুই একটা প্রাণী। সংস্কৃতি ছাড়া কোনো শিক্ষা পূর্ণ হতে পারে না। পাঠ্যধারায় নম্বরসহ যুক্ত করতে হবে সংস্কৃতিকে।সমাবেশে ‘উগ্রবাদের জায়গা নেই, এসো একতার গান গাই’, ‘ভিন্নমত শ্রদ্ধা করি, সম্প্রীতির দেশ গড়ি’, ‘বিভাজন নয়-সম্প্রীতি, সহিংসতা নয়-ভালোবাসা’ ‘ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে, বাস করব মিলেমিশে’, ‘উগ্রবাদ বর্জন করি, সংস্কৃতিচর্চার সমাজ গড়ি’ প্ল্যাকার্ড বহন করছিলেন শিল্পীরা।এফটিপিওর চেয়ারম্যান নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পী মামুনুর রশীদ বলেন, সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিকর্মীদের বিরুদ্ধে একটি চক্র যা করছে, সে তুলনায় রুখে দাঁড়াতে পারেননি সংস্কৃতিকর্মীরা। শারদীয় দুর্গোৎসবে হামলার প্রতিবাদে প্রতিটি সাংস্কৃতিক সংগঠনকে আলাদা কর্মসূচি নিতে হবে। সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করতে হবে। সামনে বড় সমাবেশের কর্মসূচি নেওয়া হবে।





সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, সবার আগে রাজনীতিকে অসাম্প্রদায়িক হতে হবে। রাজনীতি ও সংস্কৃতি পাশাপাশি না চললে এ সংকটের সমাধান হবে না।ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পী সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, শিল্পীরা মানুষের মনন গঠনের কাজ করেন। সাম্প্রদায়িক চক্রের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করা এখন শিল্পী সমাজের দায়িত্ব।অভিনয়শিল্পী পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, যেভাবে রাজপথে শিল্পীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন, সেভাবে ডিজিটাল মাধ্যমে সম্প্রীতির ডাক দিতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে।টেলিভিশন নাট্যকার সংঘের সভাপতি মাসুম রেজা বলেন, এ দেশের সব আন্দোলনে শিল্পীরা লেখনী, অভিনয়, গান, নির্মাণ দিয়ে ও রাজপথে থেকে আন্দোলন করেছে। প্রত্যেককে একসঙ্গে প্রতিবাদ না করলে এ সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।





আগের সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার হয়নি উল্লেখ করে প্রেজেন্টার্স প্ল্যাটফর্ম অব বাংলাদেশের সহ সভাপতি ফেরদৌস বাপ্পী বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হলে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক বিভক্তি থামানো সম্ভব নয়।অভিনয়শিল্পী শমী কায়সার বলেন, চেতনাগত জায়গায় বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক। বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে মোকাবিলা করতে হবে।এই সমাবেশের প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক অভিনয়শিল্পী ইরেশ যাকের বলেন, ‘এ হামলার ঘটনা কেন ঘটল? আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে ব্যর্থ। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে আমরা মানুষের হৃদয়ে পৌঁছাতে পারিনি।’





জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সংলাপ রচয়িতা ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক মহাপরিচালক এস এম হারুন-অর-রশীদ বলেন, শুভ বুদ্ধির মানুষের কর্মতৎপরতার ঘাটতি আছে এখন। রাজনীতিবিদ, সরকার, বিরোধী দল, শিল্পীদের মধ্যে এই ঘাটতি রয়েছে। শিল্পীদের দায়িত্ব মানুষের মধ্যে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা তৈরি করা, যা বাস্তবায়ন করবেন রাজনীতিবিদেরা।মুক্তিযোদ্ধা অভিনয়শিল্পী জিয়াউল হাসান কিসুল বলেন, এখন অভিভাবকেরা সন্তানদের প্রকৃত ধর্ম শিক্ষা দেন না। পরিবার থেকে ছেলেমেয়েদের মনে ধর্মীয় বিভেদ, বিদ্বেষের বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।





প্রতিবাদ সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন অভিনয়শিল্পী নিমা রহমান, আবুল কালাম আজাদ, তারিন জাহান, দীপা খন্দকার, তুষার খান ও মীর সাব্বির, নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরীও দেবাশীষ বিশ্বাস, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজিদ, বাংলাদেশ নাট্যকার সংঘের সাধারণ সম্পাদক এজাজ মুন্না, বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার সহসভাপতি কবিরুল ইসলাম রতন, নৃত্যাঞ্চলের অন্যতম পরিচালক শিবলী মোহাম্মদ, বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন, বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার উপদেষ্টা ডলি ইকবাল, অভিনয়শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব নাসিম, সংস্কৃতিকর্মী অরুণ সরকার, ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের ট্রাস্টি সদস্য জুলহাস নূর, টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক সাজু মুনতাসীর, প্রেজেন্টার্স প্ল্যাটফর্ম অব বাংলাদেশের সহ সভাপতি খন্দকার ইসমাইল, ডিরেক্টরস গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক এস এম কামরুজ্জামান সাগর, মেকআপম্যান অ্যাসোসিয়েশনের মো. আলী বাবুল, বাংলাদেশ অডিও ভিজ্যুয়াল টেকনিক্যাল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এভিটোয়া) সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম বাবলু এবং সংগীত-সংশ্লিষ্ট তিন সংগঠন গীতিকবি সংঘ, মিউজিক কমপোজার্স সোসাইটি, কণ্ঠশিল্পী পরিষদ বাংলাদেশের সম্মিলনে মোর্চা সংগঠন সংগীত ঐক্য বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন উপস্থাপক আনজাম মাসুদ।




