অবশেষে দেশের কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর হারানো স্বজনদের ফিরে পেলেন আলম ওরফে নূরুল হক, আশ্রয় পেলেন সন্তানের প্রতিক্ষায় পাথর হয়ে যাওয়া প্রায় ৮০ বছরের বৃদ্ধা মায়ের বুকে। নরসিংদী সদর উপজেলার কাঁঠালিয়া ইউনিয়নের থামারদী গ্রামের আপন জন্মগৃহে আনুষ্ঠানিক ভাবে আলমকে তার মা জাহানারা বেগমের বুকে ফিরিয়ে দেন ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ী ইউনিয়নের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোঃ রফিক মিয়া।





এক দিন, সপ্তাহ, মাস কিংবা বছর নয়, নিজের মা-বাবা, ভাই বোন কিংবা কোন আপন আত্মীয় স্বজন ছাড়া জীবনের ৪০-৪২টি বছর কাটিয়েছেন নিজের এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় অন্যের বাড়িতে ৫০ বছর পেরোনো মোঃ আলম। নিজের বাবা আসকর আলীর নাম বলতে পারলেও ভুলে গেছেন জন্মদায়ী মায়ের নাম। পোস্ট কাঁঠালিয়া থামারদী গ্রামে তার জন্ম। বলতে পারছেন কামরাঙ্গারীর চর নামে একটি বাজারের নাম। এছাড়া এলাকার বিষয়ে অন্য কিছু মনে নেই আলমের। হারানো পরিবার পরিজন সম্পর্কে তার ছোট দুই ভাই শামছুল হক ও সিরাজুল হক। চাচাত ভাই আয়াত আলী, শরাফত আলী ও মারফত আলী নামগুলোই শুধু বলতে পেলেন।





এই বিষয়গুলো জানার পর মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলম যেন তার পরিবারকে ফিরে পায় সেই আশা করে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ী ইউনিয়নের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোঃ রফিক মিয়া পত্র পত্রিকায় বিষয়টি প্রচার করার জন্য স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকের সাথে আলোচনা করেন। এরপর আলমের অজানা নানা কথা নিয়ে শুরু হয় অনুসন্ধান। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত নিয়ে গত ২০ অক্টোবর সংবাদ প্রকাশের পর নারায়নগঞ্জের আড়াইহজার পৌরসভার ৭,৮ও৯ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর মোছাঃ শামসুন নাহার সংবাদটি পড়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন।





পরে পত্রিকার অফিসের মাধ্যমে দৈনিক আমার সংবাদের ময়মনসিংহের ভালুকা প্রতিনিধি আবুল বাশার শেখ ও দৈনিক নবচেতনার ভালুকা প্রতিনিধি মোঃ আল-আমিনের সাথে যোগাযোগ করে আলম ও তার পরিবার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নেন। কারণ তার তিন বোনকে কাঁঠালিয়া ইউনিয়নের থামারদী গ্রামে বিয়ে দিয়েছেন। তার এক বোনের বাড়ীর কাছেই আসকর আলীর বাড়ী। সংবাদে প্রকাশিত আলমের আপন ও চাচাতো ভাইদের নামগুলো মিলে যায়। তিনি জানান, আলমের মা জাহানারা বেগম জীবিত থাকলেও প্রায় ২০ বছর আগে তার বাবা আসকর আলী মারা গেছেন।





ছোটবেলায় আলমের নাম ছিল নূরুল হক। পরে বিষয়টি আরও বেশী যাচাই করার জন্য নরসিংদী সদর উপজেলার কাঁঠালিয়া ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড সদস্য নাসির মিয়ার সাথে যোগাযোগ করা হলে উনিও সত্যতা খোঁজে পান। এরপর আলমের বউ ছেলে মেয়ে তার বাড়ীতে যাওয়ার জন্য পাগল প্রায় হয়ে গেলে গত শনিবার (৩০ অক্টোবর) সকালেই ভালুকা থেকে দু’টি গাড়ী নিয়ে রওনা দেন নরসিংদী সদরের থামারদী গ্রামে আলমের বাড়ীর উদ্দেশ্যে। দুপুর ১টায় আলমের বাড়ীতে পৌছলে সেখানে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মা ও ছেলের মিলন মেলা দেখতে গ্রামের হাজারো মানুষ ভীর করে। ৪০-৪২ বছর পর মা তার হারানো সন্তানকে বুকে টেনে নেন। পরিবারের সকলের চোখের অশ্রু তবে তা বিষাদের নয় আনন্দের অশ্রু। হারানো স্বজনদের ফিরে পাওয়ার অশ্রু। এলাকার সকল গণ্য মান্য ব্যক্তিগণ উপস্থিত থেকে সেই মিলন মেলা উপভোগ করেন।





এ সময় আলমের মা জানান, আমার হারানো মানিক আমার বুকে ফিরে এসেছে আমি খুশি হয়েছি। আমি কতটুকু খুশী হয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। যাদের মাধ্যমে আমার ছেলেকে ফিরে পেলাম তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করি। তার সহোদর ভাই শামছুল হক বলেন, আমি মিডিয়ার মাধ্যমে আমার ভাইকে ফিরে পাওয়ায় মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।





তার চাচাতো ভাই মারফত আলী বলেন, ছোটবেলায় লোকমান নামে আমাদের এক জেঠাত ভাই হারিয়ে গেলে নূরুল হক তাকে খোঁজতে যায়। ৮/১০দিন পর লোকমান ফিরে এলেও নূরুল হক আর ফিরে আসেনি। সে হারিয়ে যাওয়ার পর সবাই মিলে কতো খোঁজা খোঁজি করলাম কোথাও পাইনি। আমার জেঠা নুরুল হকের বাবা নিজের জমি বিক্রি করে ছেলে খোঁজাখোঁজি করে সম্পদও নষ্ট করে ফেলেছে, তাও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। আজ মিডিয়ার মাধ্যমে তাকে আমরা কাছে পেয়ে অনেক খুশি, আনন্দে বুকটা ভরে গেছে।





আলমের চাচী নুরুল হককে জড়িয়ে ধরে বলেন, তোর বাবা থাকলে অনেক খুশি হতো, তোকে খুঁজে পেতে তোর বাবা পাগলের মতো দেশে দেশে ঘুরেছে। প্রতিবেশীরা সাংবাদিকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার বলেন, ৪০-৪২ বছর পরে আপনাদের মাধ্যমে যে আলমকে আমরা ফিরে পাবো সেটা কল্পনায়ও ছিলোনা, আপনাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ।এলাকাবাসী জানান, আলমের বাবা এলাকায় বেশ জনপ্রিয় ও তাদের গোষ্ঠি এলাকায় বেশ প্রতাপশালী ছিল। আলমকে খোঁজতে গিয়ে তার বাবা অনেক সম্পদ নষ্ট করেছে কিন্তু জীবনদশায় ছেলেকে দেখে যেতে পারেন নি। আলমের জন্ম ঠিকানা ফিরে পাওয়ায় এক সময় তাকে ভালুকায় আশ্রয়দাতা হাজী শহিদুল ইসলাম বলেন আলম তার আপন ঠিকানা ফিরে পাওয়ায় আমি খুব খুশি হয়েছি।




